সঠিকভাবে এগিয়ে যাওয়া মানে সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রেও ক্যারিয়ার অর্জন করা
দুগ্ধপোষ্য সন্তানের দেখাশোনা করার জন্য বেতনভোগী কাউকে নিয়োগ না দিয়ে, এমনকি দিবাযতœ কেন্দ্রের দ্বারস্থ না হয়ে নিজেই এ-সংক্রান্ত কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। বিনিময়ে স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া যাবে ঘণ্টায় ১৫ ডলার করে। হোক সেটা মজুরি বা অন্য কিছু। এখানে একটি মজার বিষয় রয়েছে। তা হলো পরিবারের অন্যান্য খরচের সাথে সন্তান দেখভালের ওই টাকাও তারা ভাগাভাগি করেন। এখানে রয়েছে এক কর্মজীবী মায়ের লড়াই বা ধৈর্যের গল্প। তিনি হচ্ছেন মেলিসা পেট্রো। সংসারসহ পেশাগত নানা দিক বুদ্ধির সাথে সামাল দেয়ার কারণে অনেকেই মেলিসা পেট্রোকে লড়াকু মেয়ে আখ্যা দিয়েছেন।
মেলিসা পেট্রো সন্তান জন্মের আগে কাজ করেন পূর্ণকালীন ফ্রিল্যান্স লেখক হিসেবে। এ জন্য অনেকে তাকে সাংবাদিক মেলিসাও বলে থাকেন। তিনি বলেন, লেখালেখি আমার অনেক ভালো লাগে। আমি যখন লিখতে বসি তখন ভাবি না এ লেখা ছাপা হলে আমি কী পরিমাণ সম্মানী বা পারিশ্রমিক পাবো। একপর্যায়ে সাংসারিক ঝামেলাসহ নানা কারণে তিনি লেখালেখির কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হন। তবে স্বামীর সহযোগিতার কারণে মেলিসা পেট্রো ফের লেখালেখির জগতে প্রবেশের সুযোগ পান। এতে তিনি স্বামীর প্রতি খুবই সন্তুষ্ট। ডিজিটাল মিডিয়ার পরামর্শক ছিলেন তার স্বামী। সাংসারিক ব্যয় তারা সমানভাবে মেটাতেন সন্তান জন্মের আগে। মেলিসা বলেন, অনেক সময় বাস্তবতা এতটাই কঠোর বা নির্মম হয়ে দাঁড়ায়, তখন ভালোবাসা বা সমতামূলক সম্পর্ক বলে কিছুই থাকতে চায় না। এমনি একটি কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে আমি চলেছি। কিন্তু আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা সামান্যতম তো কমেইনি বরং, আরো বেড়েছে ভালোবাসা বা পারস্পরিকতা।
একসময় মেলিসা উপলব্ধি করেন, একটি নয়, কোলজুড়ে দু’টি সন্তান আসায় ফ্রিল্যান্সের কাজ তো দূরে থাক, গোসল, খাওয়া ইত্যাদির সময়ও হয়ে ওঠে না। তিনি বলেন, প্রথমবার মা হওয়ার আগে থেকেই এ সংক্রান্ত ঝক্কি-ঝামেলা যে কত বেশি তা সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারিনি। কাজ পাওয়া আমার জন্য মোটেই কষ্টসাধ্য বা দুঃসাধ্য নয়; তবে কাজ যথাসময়ে শেষ করাটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জের। সন্তান একটু বড় হলে তারা আরো চঞ্চল হয়ে ওঠে। তখন তাদের সামাল দিতে গিয়ে মাকে আরো বেশি সময় দিতে হয়, যা অনেকের দ্বারা মোটেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ জন্য প্রয়োজন বুঝদার স্বামীর। এ ধরনের মানুষ পাশে থাকলে তার সহায়তায় কাটিয়ে ওঠা যায় অনেক ধরনের হতাশা, অবসাদ, অর্থাৎ মনে থাকে প্রবল শক্তি বা আত্মবিশ্বাস। ওই সময়ে মেলিসা বিভিন্ন কাজে সময় দেয়ার মতো সুযোগ পান। একপর্যায়ে হঠাৎ তার স্বামীর চাকরি চলে যায়। তখন তিনি বুঝতে পারেন পেশাগত কাজ থেকে দূরে সরে যাওয়ার যন্ত্রণা কত বেশি। যদিও মাতৃত্বের একটি দুর্দান্ত শিক্ষায় পরিণত হয়েছিল মেলিসা পেট্রোর।
মেলিসা পেট্রো শুধুই একজন লেখক বা ফ্রিল্যান্সারই নন, তিনি একজন গবেষক, শিক্ষাবিদ, এমনকি নারীবাদীও। বলা যেতে পারে নিউ ইয়র্কের একজন স্বাধীন লেখক। তিনি লেখক প্রশিক্ষকও। তার লেখা ছাপা হয় দ্য গার্ডিয়ান, আলজাজিরা, নিউ ইনকুয়েরিসহ আরো অনেক গণমাধ্যমে। তার লেখা পড়ে অনেকে মন্তব্য করেন, লেখালেখির ক্ষেত্রে রীতিমতো রূপান্তরকামী শক্তি আবিষ্কার করেছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে মেলিসা বলেন, শিক্ষার্থীরা যে মুহূর্তে তাদের স্মৃতিগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করে, তখন তাদের মনে শুরু হয়ে যায় নতুন গল্প বলার প্রবল ইচ্ছা।
তিনি এখন কাজ করছেন আনবেকমিং শিরোনামের একটি বইয়ের স্মৃতিচারণে। তিনি বলেন, আমাদের পছন্দসই বিষয়গুলো আমরা নিজেরাই সহজেই বেছে নিতে পারি। সামাজিক সচেতনতাকে সহজেই উদ্বুদ্ধ করতে পারে লেখালেখি। অনেক নারীর জীবন উন্নত করা সম্ভব একটি নিরাপদ জায়গা তৈরির মাধ্যমে। তার এক শিক্ষার্থীকে লেখার ক্ষেত্রে তিনি বলেন, আমরা ট্রমা থেকেও সহজে মুক্তি পেতে পারি। আবার আমরা অনেক সময় এড়াতেও পারি না ট্রমাকে। ট্রমা হচ্ছে মানসিক আঘাতের কারণে সৃষ্ট স্নায়ুরোগ। এটি একটি ইংরেজি শব্দ।
তিনি প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও সমালোচনা প্রকাশ করেন বিজনেস ইনসাইডার, কসমোপলিটন, ইনস্টাইল, গুড হাউসকিপিং, প্যাসিফিক স্ট্যান্ডার্ড ম্যাগাজিনসহ আরো অনেক প্রকাশনায়। অনেক পাঠক তাকে ম্যাগাজিন রাইটার বলে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি চূড়ান্ত হন ফিউশন উদীয়মান লেখক পুরস্কারের জন্য।
মেলিসা অ্যান্টিওচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং নিউ স্কুল থেকে ক্রিয়েটিভ ননফিকেশনে এমএফএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ইউনাইটেড স্টেটসের ওহাইও’র ইয়োলো স্প্রিংস নামক স্থানের অ্যান্টিওচ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার মান বিশ্বমানের বলে মনে করা হয়। ২০১৫ সালে তিনি ফ্রিম্যান, রোকসনে গে এবং ক্রিস্টিনা হেনরিকের বিচারক হয়েছিলেন। তাদের বেশির ভাগই লেখক।
মেলিসা পেট্রো লেখকদের বিনামূল্যে, ক্ষেত্রবিশেষে স্বল্প দামে সৃজনশীল লেখার কর্মশালা সরবরাহকারী একটি সংস্থা বেকিং রাইটার্সের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রশিক্ষক। মেলিসার অনুসারীরা বলেন, আমরা সবাই জানি যে বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি (মেলিসা) তার পেশাগত কাজ এবং সংসার নিয়ে কতটা নিবেদিত। মনে হয় এখন সময় এসেছে সেই পর্যায়ে বা অধ্যায়ে তার পদচারণা দেখার। সবাই তাকে একজন আশ্চর্যজনক শিক্ষক বলেও মনে করেন। তিনি তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজের পাশাপাশি সেখানে প্রতি সপ্তাহে বাড়তি প্রায় ৫০ ঘণ্টা কাজ করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকল্পে তহবিলও সংগ্রহ করেন। তাতে বেশ প্রশংসাও পেয়েছেন মেলিসা। তারা আরো বলেন, আমরা সবাই তাকে সাধুবাদ জানাই এবং আরো সাহায্যের হাত তাকে সরবরাহ করতে পারি। যাতে করে তার এ সংক্রান্ত তহবিল আরো বড় হয়।
মেলিসা পেট্রো বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিশু শিক্ষার্থীদের তিন বছরের বেশি শিক্ষার কলা এবং সৃজনশীল লেখার অভিজ্ঞতা দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। আমি সমগ্র ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নৃতাত্ত্বিক গবেষণা চালিয়েছি অ্যান্টিওচ কলেজের স্নাতক শিক্ষার্থী হিসেবে এবং সাক্ষাৎকার নিয়েছি তাদের জীবন এবং পেশা সম্পর্কে সব দিক জড়িত নারীদের।
তিনি বলেন, আমরা ধরেই নিয়েছি যে, এমন পাঠক আছেন যারা নানা বিষয়ে চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে পারেন। লেখক ও শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন আমার অনেক আগে থেকেই ছিল। সে অনুযায়ী কাজ করেছি বলে আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। যা হলো আমার মনের সুপ্ত প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ বা প্রতিফলন। প্রতিটি মানুষের মনে কিছু সুপ্ত প্রতিভা থাকে। এগুলোকে যে জাগিয়ে তুলতে পারে সেই সফল হয় বা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে অনায়াসে। সুপ্ত প্রতিভার মৃত্যু তখনই ঘটে যখন মানুষ এসব ব্যাপারে উদাস হয়ে পড়ে। অতএব আমি চাই না কারো সুপ্ত প্রতিভার মৃত্যু ঘটুক। আমি চাই আমরা সবাই সমানভাবে এগিয়ে যাবো। স্বাধীন মতামতের অধিকার থাকা মানে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ বা অবস্থা নিশ্চিত হওয়া।
মেলিসা আর্টস কারিকুলাম ডিজাইন করতে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি চারুকলাসমৃদ্ধ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যথাযথ পরিশ্রম করেন; যেখানে একসময় কোনো চারুকলা শিক্ষক ছিল না। তিনি বলেন, ছাত্রজীবনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ক্ষেত্রে আমার যতটা প্রভাব ছিল, তাতে করে এসব ব্যাপারে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছি যথেষ্ট পরিমাণে। আমার শিল্পকর্ম অর্থাৎ লেখা আর আমার অতীত সম্পর্কে কৌতূহলী ছিলেন অনেকেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমি বেড়ে উঠেছি শ্রমজীবী পরিবারে। এবার বুঝতে হবে, আমার কেন্দ্রিক পারিপার্শ্বিক দিকগুলো কেমন ছিল। আমি আমাদের পরিবারে প্রথম কলেজে যাই। পরিশ্রম আমার জীবনে সুখ, সমৃদ্ধি, সুযোগ ইত্যাদি এনে দিয়েছে ব্যাপক হারে। সঠিকভাবে এগিয়ে যাওয়া মানে সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার অর্জন করা।
মেলিসা পেট্রো মনে করেন, নারীর কর্মসংস্থানের পথে এখনো বড় বাধা হচ্ছে পারিবারিক ও সামাজিক বাধা। এর চিত্র পাল্টাতে হলে প্রয়োজন মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন। পাশাপাশি উন্নত শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র তৈরি করতে হবে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে। আরো যেটা প্রয়োজন সেটি হলো নারীর কাজের দক্ষতা আরো বাড়াতে হবে। এ জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। পুরুষদেরও এ ব্যাপারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। আর তাহলেই আমরা পাবো একটি নারীবান্ধব বিশ্ব।